বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৩৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

করোনাকালে উন্নয়নমুখী কৃষির রূপরেখা

পাভেল পার্থ:
করোনাকাল প্রমাণ করে চলেছে কারখানাভিত্তিক উৎপাদন নয়, কৃষির মতো প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর গ্রামীণ উৎপাদনব্যবস্থাই কেবল মহামারীর মতো সংকট সামাল দিতে পারে। ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ থেকে রাষ্ট্র আমরা সবাই এটি তো আবারও আন্দাজ করতে পারছি যে, আমাদের ভোগবিলাসিতা আর একতরফা উৎপাদন-উন্নয়নের জন্যই প্রাণ-প্রকৃতির নিদারুণ দুর্দশা তৈরি হয়েছে। দিকে দিকে এখন পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষার বার্তা ঘোষিত হচ্ছে। এমনকি আমাদের জনপ্রতিনিধি কী গণমাধ্যমের অনেকেই প্রাণ-প্রকৃতিকে আগলে বিনিয়োগ আর উন্নয়নের জরুরিত্ব তুলে ধরছেন।

তাহলে করোনাকালের বাজেটে নিশ্চিতভাবেই এর প্রতিফলন থাকা জরুরি। চলতি আলাপে সরাসরি কয়েকখানা প্রস্তাব আবারও সামনে আনছি, আশা করি রাষ্ট্রঘোষিত কৃষি বাজেটের চেহারাকে পরিবেশমুখী করে তোলার জন্য প্রসারিত করবে সব দুয়ার।
করোনা স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণে কৃষকের জন্য বিশেষ বরাদ্দ : করোনাকালের কৃষি বাজেটে কৃষির সঙ্গে জড়িত কৃষক ও কৃষিপরিবারের জন্য করোনা স্বাস্থ্যবিধির উপকরণসহ চিকিৎসাব্যয় বিষয়ক বিশেষ স্বাস্থ্য সুরক্ষা খাত রাখা জরুরি। করোনাকালে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাই আমাদের প্রধান শর্ত। আর এই খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা কোনোভাবেই এককভাবে কেবল মানুষের জন্য নয়, মানুষসহ চারপাশের দেখা-অদেখা সব বৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের। তার মানে কৃষি বাজেটকে একইসঙ্গে কৃষকের স্বাস্থ্য, মাটি-পানি ও বীজের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে। আর সবার সুস্বাস্থ্যই এক স্বাস্থ্যকর কৃষি, যা আমাদের উপহার দেবে এক সবল গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতি।

প্রতি ইঞ্চি জমির প্রকৃত ব্যবহার নিশ্চিতকরণে বরাদ্দ : প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন, দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির সফল ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু দেশে প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমছে কৃষিজমি।

এখনো খসড়া হয়ে আছে ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন’। মোট কৃষিজমির প্রায় ৫ শতাংশ হলো আবার চাষের আওতায় না আসা ‘পতিত জমি’। আর অস্থায়ী পতিত জমির পরিমাণ ১ কোটি ৫৩ লাখ ৫৫ হাজার শতক। পরিবারপ্রতি প্রায় এক শতক করে অস্থায়ী পতিত জমি আছে। আর যেসব জমি এখনো আবাদের আওতায় আসেনি সেসব ‘স্থায়ী পতিত’। এমন জমির পরিমাণ ৯ কোটি ৩১ লাখ ৫৯ হাজার শতক এবং পরিবারপ্রতি প্রায় ৩ শতক করে অস্থায়ী পতিত জমি আছে। বিবিএস (২০১৮) সূত্রমতে দেশে ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৮১ হাজার ১২৭ একর পুকুর আছে। দেশের প্রতিটি গ্রাম কী শহরের বাড়ির প্রতি ইঞ্চি জায়গার প্রকৃত ব্যবহারের জন্য দরকার সামগ্রিক জনপরিকল্পনা ও প্রাসঙ্গিক বরাদ্দ। কেবল রাষ্ট্র নয়, এগিয়ে আসতে হবে ব্যক্তি ও পরিবারকে।
ভূমিহীন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের জন্য প্রণোদনা : দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে এক কোটি কৃষি পরিবার। এদের বড় অংশই ‘গণি মিয়া’। গণি মিয়ার সেই গল্প নিশ্চয়ই মনে আছে? যার নিজের কোনো জমি নেই বলে পরের জমিতে ফসল ফলায়। এরাই প্রায় ৬৫ লাখ পরিবার। ইতিহাস থেকে ইতিহাস এদের কত নাম, কত অভিধা। বর্গাচাষি, ভাগচাষি, ভূমিহীন কৃষক, কৃষিমজুর, কৃষিশ্রমিক, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। এদের জমিও নেই, দলিলও নেই। এমনকি মালিকের সঙ্গে কোনো চুক্তিপত্রও থাকে না কারও। কিন্তু সরকারের স্বল্পসুদের বা বিনাসুদের কৃষিঋণ সুবিধা পেতে হলে জমির দলিল বা চুক্তিপত্র জমা দিতে হয়। কিন্তু দেশের ৬৫ লাখ গণিমিয়ার পরিবার কীভাবে এইসব নথি জমা দেবে? তাহলে কি রাষ্ট্রের ৫০০০ কোটি টাকার কৃষি প্রণোদনা থেকে তারা বঞ্চিত হবে? কিংবা ক্ষুদ্র আয়ের কৃষক ও কৃষিউদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত ৩০০০ কোটি টাকা থেকেও কি এরা বঞ্চিতই থাকবে? তাহলে কি রাষ্ট্রের কষ্টের বাজেট চলে যাবে এই জমির মালিক ধনী কিছু পরিবারে? তাহলে কৃষি খাতে ঘোষিত হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ কীভাবে ভূমিহীন, বর্গাচাষি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা পেতে পারেন এর নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই করতে হবে।

কৃষি খাতে ভর্তুকি সরাসরি নগদে দেওয়া হোক : উপাত্ত ও বিশ্লেষণসমেত তর্ক জারি আছে কৃষি খাতে দিন দিন ভর্তুকি কমছে। আর ভর্তুকি বহাল থাকে মূলত ইউরিয়া, ডিজেলসহ দামি কৃষিপণ্য উপকরণ খাতে। এর বেশির ভাগই উৎপাদন করে করপোরেট কোম্পানিরা। রাষ্ট্রের ভর্তুকির টাকা কৃষকদের মাধ্যমে শেষমেশ এসব বড় কোম্পানির পকেটেই যায়। এবারের বাজেটে ৯৫০০ কোটি টাকা কৃষিতে ভর্তুকি হিসেবে রাখা হয়েছে। করোনাকালে এই কৃষিভর্তুকি কি সরাসরি নগদে দেশের ৬৫ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক পরিবারে দেওয়া সম্ভব? যারা এ দিয়ে নিজের বাড়িতে একটি বীজঘর তৈরি করবেন বা দশে মিলে গ্রামে একটি ‘গ্রামীণ বীজব্যাংক’। কিংবা গলাছিলা মুরগি, পাতি হাঁস, দেশি ছাগল বা গরুর একটা ছোট খামার। কিংবা ভূ-উপরিস্থ পানিকে ব্যবহারের জন্য লোকায়ত সেচ ব্যবস্থাকে চাঙ্গা করতে। তাহলে কৃষক পরিবার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে পরিবার ও এলাকা উপযোগী কী ধরনের উদ্যোগ তার বাস্তবায়ন দরকার। এতে ভর্তুকির টাকা একটি গ্রামীণ সমাজে নানাভাবে বিন্যস্ত হবে। কৃষিতে কোম্পানিমুখী উপকরণ নির্ভরতা কমে একটা পরিবেশমুখী গ্রামীণ স্বনির্ভরতার ব্যাকরণ তৈরি হবে।

নারীর জন্য কৃষি খাত : নারীই কৃষির উদ্ভাবক আর বীজের ঐতিহাসিক সংরক্ষক। কিন্তু কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের নামে নারীর বীজ ভা-ার আজ লুণ্ঠিত। কৃষি খাত থেকে গ্রামীণ নারীর একটা বড় অংশ আজ গার্মেন্টস শ্রমিক। কিন্তু এই করোনাকালেও যখন দেশদুনিয়া লকডাউন হয়ে আছে, যখন করপোরেট কোম্পানিগুলোর বীজের দোকান বন্ধ তখন গ্রামে গ্রামে নারীরাই নিজেদের সংরক্ষিত বীজ একের সঙ্গে অন্যে বিনিময় করেছেন। করেছেন শস্য ফসল বিনিময়। পরিসংখ্যানে ক্ষুদ্র হলেও করোনাকালে নারীর এই বীজবিনিময় শক্তি প্রমাণ করে এখনো গ্রামীণ নারীদের মাধ্যমেই দেশের বীজ খাত স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা সম্ভব। গ্রামীণ নারীর বসতবাড়ি ও পুষ্টিবাগানগুলো করোনাকালে পরিবার ও প্রতিবেশীর খাদ্য-পুষ্টির জোগান দিয়েছে। কৃষিতে গত দশ বছরে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। গ্রামীণ নারীর কৃষি খাত এবং কৃষির সব স্তরে নারীর জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ এবং এসব বাজেট প্রাপ্তি ও ব্যবহার প্রান্তিক গ্রামীণ নারীর অগ্রাধিকার জরুরি।

জাতীয় কৃষি কমিশন গঠন : করোনাকালের বোরো মৌসুমে প্রতি মণ ধানের দাম সরকার নির্ধারণ করে ১০৪০ টাকা। সরকার নির্ধারিত মাত্রায় কিছু ধান-চাল কিনেছে। বাদবাকি ধান বেচে কৃষকের এবারও চাষের খরচ জোটেনি। কেবল ধান নয় মৌসুমভিত্তিক সব শস্যফসল ও গ্রামীণ কৃষি উৎপাদন বিপণন, পরিবহন, মজুদকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কৃষিমুখী শিল্প বিস্তারে রাষ্ট্রকে এখনই সোচ্চার হতে হবে। আর এক্ষেত্রে বিশেষ বরাদ্দ রাখাও জরুরি। ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ থেকে শুরু করে কৃষির সামগ্রিক সমন্বয়ের জন্য ‘জাতীয় কৃষি কমিশন’ গঠন এখন সময়ের দাবি। করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গ্রামীণ নারীর বীজভা-ার থেকে শুরু করে কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার সবই এর আওতায় আসতে পারে। স্থানীয় কৃষক, কৃষক সংগঠন, স্থানীয় সরকারের স্ট্যান্ডিং কমিটি, গণমাধ্যমকর্মী, জনপ্রতিনিধি, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, সামাজিক সংগঠন, গবেষক, স্বাস্থ্যকর্মী, উন্নয়ন প্রতিনিধি, যুব প্রতিনিধি, বাজার কমিটি, উদ্যোক্তা সবাই মিলেই স্থানীয় পর্যায়ে এই কমিশনের কাজকে অবিচল রাখতে পারে।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION